হজ্বের প্রকারভেদ
পবিত্র হজ্ব তিন প্রকার-
তামাত্তু হজ্ব
কিরান হজ্ব
ইফরাদ হজ্ব
এই তিন প্রকার হজ্বের সংক্ষিপ্ত বিবরনী তুলে ধরা হলোঃ
হজ্বে তামাত্তু
হজ্বের মাসসমূহে (শওয়াল, জিলকদ এবং জিলহজ) উমরাহ্ এর নিয়তে ইহরাম করে, উমরাহ্ পালন করে অতঃপর হজ্বের নিয়ত করে হজ্ব পালন করাকে ‘হজ্বে তামাত্তু’ বলে।
তামাত্তু হজ্বের নিয়ম
উমরাহ্ এর ইহ্রাম (ফরজ)
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সেরে গোসল বা অজু করে নিন।
মিকাত অতিক্রমের আগেই সেলাইবিহীন একটি সাদা কাপড় পরিধান করুন এবং আরেকটি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ইহ্রামের নিয়তে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নিন।
শুধু উমরাহ্ এর নিয়ত করে এক বা তিন বার তালবিয়া পড়ে নিন।
তালবিয়া হলো-
লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক,
লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক,
ইন্নাল হামদা ওয়ান্-নি’মাতা লাকাওয়ালা মূলক
লা-শারীকা লাক্।
Talbiyah |
উমরাহ্ এর তাওয়াফ (ফরজ)
অজুর সঙ্গে ইজতিবা (ইহ্রামের চাদরকে ডান বগলের নিচের দিক থেকে পেঁচিয়ে এনে বাঁ কাঁধের ওপর রাখা) সহ তাওয়াফ করুন।
হাজ্রে আস্ওয়াদ সামনে রেখে তার বরাবর ডান পাশে দাঁড়ান (২০০৬ সাল থেকে মেঝেতে সাদা মার্বেল পাথর আর ডান পাশে সবুজ বাতি)।
ডানে গিয়ে এমন ভাবে দাঁড়াবেন, যেন হাজ্রে আস্ওয়াদ পুরোপুরি আপনার সামনে থাকে।
এরপর দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত তুলে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়ুন এবং হাত ছেড়ে দিন, আতঃপর হজ্রে আস্ওয়াদের দিকে হাত ইশারা করে হাতের তালুতে চুমু খেয়ে পূর্ণ বাঁ দিকে কাবা ঘরকে রেখে ডান দিকে চলতে থাকুন। পুরুষের জন্য প্রথম তিন চক্কর ‘রমল’ (বীরের মতো বুক ফুলিয়ে কাঁধ দুলিয়ে ঘন ঘন কদম রেখে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলা) করা সুন্নত।
রুক্নে ইয়ামিনকে সম্ভব হলে শুধু হাতে স্পর্শ করুন এবং চুমু খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
রুক্নে ইয়ামিন থেকে হজ্রে আস্ওয়াদের মাঝখানে ‘রব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতে হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান-নার, ওয়াদখিলনাল জান্নাতা মা’আল আবরার, ইয়া আযিযু ইয়া গাফফার, ইয়া রব্বিল আলামিন’ এই দোয়া পাঠ করুন অতঃপর হাজ্রে আস্ওয়াদ পর্যন্ত এসে চক্কর পূর্ণ করুন।
পুনঃরায় হাজ্রে আস্ওয়াদ বরাবর দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে দ্বিতীয় চক্কও শুরু করুন। এভাবে সাত (হাতে সাত দানার তসবিহ অথবা গননা যন্ত্র রাখেতে পারেন যেন সাত চক্কর ভুল না হয়) চক্করে তাওয়াফ শেষ করুন।
তাওয়াফের দুই রাকাত নামাজ (ওয়াজিব)
মাকামে ইব্রহীমের পেছনে বা হারামের যে কোন স্থানে তাওয়াফের নিয়তে (মকরুহ্ সময় ছাড়া) দুই রাকাত নামাজ আদায় করে দোয় করুন। মনে রাখবেন এটা দোয়া কবুলের উত্তম স্থান।
উমরাহ্ এর সাঈ (ওয়াজিব)
সাফা পাহড়ের উপরে উঠে (এখন আর পাহাড় নেই, মেঝেতে মার্বেল পাথর এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত) কাবা শরিফের দিকে মুখ করে সাঈ এর নিয়ত করে, দোয়ার মতো করে দুই হাত তুলে তিনবার তাকবির বলে দোয়া করুন।
এরপর মারওয়ার দিকে রওনা হয়ে দুই সবুজ দাগের মধ্যে (এটা সেই জায়গা যেখানে হজরত বিবি হাজেরা [রাঃ] পানির জন্য দৌড়েছিলেন) একটু দ্রুত পথ চলে মারওয়ায় পৌছালে এক চক্কর পূর্ণ হবে। মারওয়ার পাহাড়ে উঠে কাবা শরিফের দিকে মুখ করে দোয়ার মতো করে হাত তুলে তাকবির পড়–ন এবং আগের মতো চলে সেখান থেকে সাফায় পৌছালে দ্বিতীয় চক্কর পূর্ণ হবে। এভাবে সপ্তম চক্করে মারওয়া গিয়ে সাঈ শেষ করে দোয়া করুন।
হলক করা (ওয়াজিব)
পুরুষ হলে রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আদর্শ অনুসারে সম্পূর্ন মাথা মুন্ডন করবেন, তবে মাথার চুল ছাঁটতেও পারেন। মহিলা হলে চুলের মাথা এক ইঞ্চি পরিমান কাটবেন। এ পর্যন্ত উমরাহ্র কাজ শেষ।
হজ্বের ইহ্রাম না বাঁধা পর্যন্ত আগের মতো সব কাজ করতে পারবেন।
হজ্বের ইহ্রাম (ফরজ)
হারাম শরিফ বা বাসা থেকে আগের নিয়মে শুধু হজ্বের নিয়তে ইহ্রাম বেঁধে ৮ জিলহজ জোহরের আগেই মিনায় পৌঁছে যাবেন।
মিনায় অবস্থান (সুন্নত)
৮ জিলহজ জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজর সহ মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করুন এবং এ সময় মিনায় অবস্থান করুন।
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান ( ফরজ)
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান হজ্বের অন্যতম একটি ফরজ। ৯ জিলহজ দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন এবং নিজ তাবুতে জোহর ও আসরের নামাজ নির্দিষ্ট সময়ে আলাদাভাবে আদায় করুন। মুকিম হলে চার রাকাত পূর্ন পড়–ন। মসজিদে নামিরা’য় উভয় নামাজ জামাতে পড়লে একসঙ্গে আদায় করতে পারেন। যদি ইমাম মুসাফির হন আর মসজিদে নামিরা থেকে আপনার অবস্থান দূরে হয় তাহলে সেখানেই অবস্থান করুন। মাগরিবের নামাজ না পড়ে মুজদালিফার দিকে রওনা হোন।
মুজদালিফায় অবস্থান (ওয়াজিব)
আরাফায় সর্যাস্তের পরমুজ দালিফায় গিয়ে এশার সময় মাগরিব ও এশা এক আজান ও এক ইকামতে আদায় করুন। এখানেই রাত যাপন করুন (এটি সুন্নত) এবং ১০ ই জিলহজ সূর্যদয়ের আগে কিছু সময় অবশ্যই মুজদালিফায় অবস্থান করুন (এটি ওয়াজিব) । তবে দুর্বল (অপারগ) ব্যাক্তি ও নারীদের বেলায় এটি অপরিহার্য নয়। রাতে ছোট ছোট ছোলার দানার মতো ৭০ টি কঙ্কর সংগ্রহ করুন। মুজদালিফায় কঙ্কর খুব সহজেই পেয়ে যাবেন।
কঙ্কর নিক্ষেপ (প্রথম দিন)
১০ই জিলহজ ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শুধু বড় জামারাকে (বড় শয়তান) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করুন (ওয়াজিব)। এ সময় সম্ভব না হলে এ রাতের শেষ পর্যন্ত কঙ্কর মারতে পারেন। দূর্বল (অপারগ) ব্যাক্তি ও নারীদের জন্য রাতেই কঙ্কর নিক্ষেপ উত্তম ও নিরাপদ। কঙ্কর নিক্ষেপের স্থানে বাংলা ভাষায় গুরুত্বপূর্ন দিক নির্দেশনা দেয়া হয়; তা মনযোগ দিয়ে শুনুন এবং তা মেনে চলুন।
কোরবানি করা (ওয়াজিব)
১০ই জিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপের পর আপনার কোরবানি নিশ্চিত করুন, কেননা এটি জরুরী। কোরবানির পরই কেবল রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আদর্শ অনুসারে সম্পূর্ন মাথা মুন্ডন করবেন, তবে মাথার চুল ছাঁটতেও পারেন আর মহিলা হলে চুলের মাথা এক ইঞ্চি পরিমান কাটবেন এবং সেই সাথে খেয়াল রাখবেন কঙ্কর নিক্ষেপ, কোরবানি করা ও চুল কাটার মধ্যে ধারাবাহিকতা জরুরী; ইহা ওয়াজিব। অন্যথায় দম বা কাফ্ফারা দিয়ে হজ্ব শুদ্ধ করতে হবে। বর্তমানে এ সমস্যা সমাধানের সহজ উপায় হজ্বে ইফরাদ করা, এই হজ্বে কোরবানি নেই। হজ্বের পর উমরাহ্ করা যায়।
তাওয়াফে জিয়ারত (ফরজ)
১২ই জিলহজ সূর্যাস্তের আগেই তায়োফে জিয়ারত করা উত্তম আর তা না হলে ১২ই জিলহজের পর তাওয়াফ করে দম দিতে হবে। তবে নারীরা প্রকৃতিক কারনে করতে না পারলে পবিত্র হওয়ার পর করবেন।
কঙ্কর নিক্ষেপ (ওয়াজিব)
১১ই জিলহজ ও ১২ই জিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। ১১-১২ই জিলহজ দুপুর থেকে সময় আরম্ভ হয়। ভিড় এড়ানোর জন্য আসর নামাজের পর অথবা আপনার সুবিধাজনক সময় সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করুন- প্রথমে ছোট শয়তান তারপর মধ্যম শয়তান এবং সব শেষে বড় শয়তানকে পর্যাক্রমিক। সম্ভব না হলে শেষ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন যদিও দূর্বল ব্যক্তি ও নারীদের জন্য রাতেই নিরাপদ।
মিনায় রাত্রি যাপন (সুন্নত)
মিনায় অবস্থানরত সময়ে (১০ই ও ১১ই জিলহজ) মিনাতেই রাত্রি যাপন করুন আর ১২ই জিলহজ রাত্রি যাপন করুন , যদি ১৩ই জিলহজ ‘রমি’ (কঙ্কর নিক্ষেপ) শেষ করে ফিরতে চান।
মিনা ত্যাগ
১৩ই জিলহজ মিনায় থাকতে না চাইলে ১২ই জিলহজ সন্ধ্যার আগেই মিনা ত্যাগ করুন, ইহাই উত্তম।
বিদায়ী তওয়াফ (ওয়াজিব)
বাংলাদেশ থেকে আগত হজ্বযাত্রীদের হজ্ব শেষে বিদায় তাওয়াফ করতে হয়। তবে হজ্ব শেষে যে কোনো নফল তওয়াফই বিদায়ী তাওয়াফে পরিনত হয়ে যায়। নারীরা ঋতুর কারনে বিদায়ী তাওয়াফ করতে না পারলে ক্ষতি নাই এবং কোন প্রকার দম বা কাফ্ফারাও দিতে হয় না।
কিরান হজ্ব
- জেদ্দা পৌঁছানোর আগেই ইহ্রাম কারার কাজ শেষ করুন। তবে তালবিয়ার আগেই হজ্ব ও ইমরাহ্ উভয়ের নিয়ত একসঙ্গে করুন। (ফরজ)
- পূর্বে বর্ণিত নিয়মে উমরাহ্র তাওয়াফ করুন। (ওয়াজিব)
- এরপর সাঈ করুন। যদি এ সময় সাঈ করা সম্ভব না হয় তবে তাওয়াফ জিয়ারতের পর করুন। (ওয়াজিব)
- তাওয়াফে কুদুম করুন। (সুন্নত)
- উমরাহ্র সাঈ করুন, তবে এর পর চুল ছাঁটবেন না; বরং ইহরামের সব বিধান মেনে চলুন। (ওয়াজিব)
- জিলহজ মাসের ৮ তারিখ জোহর থেকে ৯ তারিখ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করুন এবং এ সময় মিনায় অবস্থান করুন। (সুন্নত)
- আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন। (ফরজ)
- জিলহজ মাসের ৯ তারিখ সূর্যাস্তের পর থেকে মুজদালিফায় অবস্থান এবং মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে এশার সময় আদায় করুন। (সুন্নত)
- জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ফজরের পর কিছু সময় মুজদালিফায় অবস্থান করুন। (ওয়াজিব)
- জিলহজ মাসের ১০ তারিখ কঙ্কর নিক্ষেপ করুন। (ওয়াজিব)
- কোরবানি করুন। (ওয়াজিব)
- মাথার চুল মুন্ডন করে নিন, তবে চুল ছাঁটতেও পারেন। (ওয়াজিব)
- তাওয়াফে জিয়ারত করুন এবং সাঈ করে নিন, যদি তাওয়াফে কুদুমের পর তাওয়াফ জিযারত না করে থাকেন। (ফরজ)
- জিলহজ মাসের ১১ ও ১২ তারিখ কঙ্কর নিক্ষেপ করুন। (ওয়াজিব)
- মিনায় অবস্থানকালে সেখানেই রাত্রি যাপন করুন। (সুন্নত)
ইফরাদ হজ্ব
- শুধু হজ্বের নিয়তে ইহ্রাম বাঁধুন। (ফরজ)
- মক্কা শরিফে পৌঁছে তাওযাফে কুদুম করুন। (সুন্নত)
- সাঈ করুন। এ সময় সম্ভব না হলে তাওয়াফ জিয়রতের পর সাঈ করুন। (ওয়াজিব)
- মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করুন এবং রাত্রি যাপন করুন। (সুন্নত)
- আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করুন। (ফরজ)
- মুজদালিফায় অবস্থান করুন। (সুন্নত)
- ফজরের পর কিছু সময় মুজদালিফায় অবস্থান করুন। (ওয়াজিব)
- জিলহজ মাসের ১০ তারিখ জামারায় ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করুন। (ওয়াজিব)
- যেহেতু এ হজ্বে কোরবানি ওয়জিব নয়, তাই কঙ্কর নিক্ষেপের পরম মাথা হলক করে নিন। (ওয়াজিব)
- তাওয়াফে জিয়ারত করুন। (ফরজ)
- যদি তাওয়াফে কুদুমের পর সাঈ না করে থাকেন তবে সাঈ করে নিন। (ওয়াজিব)
- জিলহজ মাসের ১১-১২ তারিখে পূর্বে বর্নিত নিয়মানুসারে উল্ল্যেখিত সময়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করুন। (ওয়াজিব)
No comments:
Post a Comment